• মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জৈষ্ঠ ১৪২৮

জাতীয়

শ্রমজীবীর অধিকার আদায়ের দিন আজ

গরিবেরও ক্ষুধা আছে

  • ''
  • প্রকাশিত ০১ মে ২০২৪

মো. বাবুল আক্তার:

বাংলাদেশ সবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লিখিয়েছে। কিন্তু বিশে^র কাছে এখনো একটি গরিব দেশ হিসাবেই পরিচিত। দেশে এখন পর্যন্ত প্রতি চারজন মানুষের একজন ক্ষুধার্ত থাকে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে বেকার মানুষের সংখ্যা ২৪ লাখ ৩০ হাজার। অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিক তার ন্যায্য অধিকার টুকুও পাচ্ছে না। ফলে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। এ অবস্থার মধ্যে আজ বিশ^জুড়ে পালিত হচ্ছে ১৩৮তম মে দিবস। এই দীর্ঘ সময়ে নিয়ম কতটা বদলালো তা এখনো জানে না শ্রমজীবী মানুষ।

দায়িত্বশীলরা যতটা সম্ভব নগদ উন্নয়নের পেছনে পড়িমরি করে দৌড়ায়। উন্নয়নে কারও থেকে পিছিয়ে পড়তে চায় না। কারণ পিছিয়ে পড়লেই তো হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু উন্নয়নের পেছনে অন্ধের মতো ছুটতে গিয়ে, দেশের শ্রমিকের মৌলিক অধিকার কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো, সেটা দেখার কোনো সুযোগ থাকে না বললেই চলে। এ যেন ‘দূরের বাদ্য’ শোনার ইচ্ছাটাও হারিয়ে যায় তাদের।

জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ৫ কোটি ২৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ মানুষ। আর তীব্র ও মাঝারি ধরনের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষ ৬ বছরে বেড়েছে ১৮ লাখ।

দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে কাজ না করা মানুষের সংখ্যা। একই সঙ্গে কমছে চাকরিতে নিয়োজিত কর্মীর সংখ্যাও। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন মানুষের বসবাস ঢাকা বিভাগে। আর সবচেয়ে কম কর্মহীন মানুষ বসবাস করে বরিশাল বিভাগে। সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদনে এমন চিত্র ওঠে এসেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২৯ দশমিক ৩২ শতাংশ মানুষ কর্মহীন। অথচ ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী এই হার ছিল ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। তাহলে কাজের দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও এসব কর্মহীন মানুষগুলো পরিবারের কারো না কারো আয়ের উপরে চলতে হয়।

আজ ১ মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের এ দিনটি বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। এ দিবসে সব সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। তবুও কিছু মানুষকে দেখা যায় প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে রুটি রোজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। কারণ একবেলা কাজ না করলে তার পরিবারকে কাটাতে হবে অনাহারে। প্রতিদিনের ন্যায় আজও আহারের জোগান দিতে কাজে বের হয়েছেন অনেকে, তাই মেলেনি ছুটি।

এদিকে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে এ সময়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম চোখে পড়ার মতো। কাজ করতে হচ্ছে ৮ ঘণ্টার অধিক। তবে দেওয়া হচ্ছে না ওভার টাইম বা অতিরিক্ত সময়ের পয়সা। মে দিবস উদযাপন তো এই মানুষগুলোর কাছে একপ্রকার বিলাসিতা। আমরা দেখি বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কর্মরত। প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানায় ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ হয় প্রতিদিন। আনুমানিক ৬৫ শতাংশের বেশি কারখানায় রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ হয়।

শুধু গার্মেন্টস নয়, অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি একজন বাস চালকের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম। তিনি দিনে প্রায় ১৬-১৮ ঘণ্টা বাস চালান। এ ক্ষেত্রে মালিক পক্ষের জোরপূর্বক নয়, অনেকটা নিজের তাগিদে অতিরিক্ত সময় কাজ করছেন তারা। কারণ অতিরিক্ত কাজ না করলে তার সংসারের দৈনিক ন্যূনতম খরচের টাকা উপার্জন করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগুলো হলো সামষ্টিক কতগুলো সূচকে আমাদের অবস্থান সন্তোষজনক। যেমন : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ ও রপ্তানি বেড়ে যাওয়া, এগুলো সামষ্টিক অর্থনীতি। কিন্তু, সেই প্রবৃদ্ধিটা কোন কোন খাতে এসেছে, সেটার ব্যবচ্ছেদ (ডি কন্সট্রাক্ট) করলে দেখা যায়, রপ্তানি বা পরিষেবা খাতে প্রবৃদ্ধি এসেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির এ প্রবৃদ্ধিটার পেছনে রয়েছে শ্রমিকদের সব থেকে বড় অবদান। কিন্তু, সেগুলোর প্রভাব শ্রমিক বা সাধারণ মানুষের ওপরে নেই। অর্থাৎ ভালো করার সুফল সামষ্টিকভাবে সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। রপ্তানি আয় বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, সেবা খাতে আয় বাড়ছে, বড় বড় কল-কারখানায় আয় বাড়ছে, এতে কিছু মানুষের সুবিধা হচ্ছে। কিন্তু, সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়টা আমাদের হয়নি। বিশেষ করে আমাদের শ্রমজীবী মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও কর্মসংস্থানে উন্নতি হয়নি। এসব শ্রমজীবী গরিব মানুষগুলোর ও ক্ষুধা আছে। তাই রাষ্ট্র কেই তাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গত দুবছর দেশে দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতির অত্যন্ত অবনতি হয়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় অনেক কমে গেছে। প্রকৃত আয় কমলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রথম ধাক্কাটা পড়ে খাবারের ওপর। এতে সব থেকে বিপদে পড়েন দৈনন্দিন শ্রমজীবী মানুষগুলো। আয়-ব্যয় সমন্বয় না করতে পেরে তাদের খাবারের মান ও পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। যার পরিণতি ক্ষুধার্ত-অনাহারে থাকা ও অপুষ্টিতে ভোগা। আবার এরকম পরিস্থিতিতে চিকিৎসা নেওয়া বাদ দিয়ে দিতে হয়। যার ফলে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অসুস্থতা আরও বাড়ে। যেটা হলো খাদ্যের অভাবে অসুস্থতা।

তিনি বলেন, সরকারের নিয়মিত অভ্যাস হলো সমস্যা ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। এখন সমস্যা যেটা হয় যে, সরকার যখন কোনো বিষয় অস্বীকার করে, তখন তো আর সেটা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কারণ তারা তো অস্বীকারই করছে। এ পরিস্থিতি যে খারাপ হয়েছে, এর পেছনে তো সরকারও দায়ী। এমন পরিস্থিতে গরিব মানুষ আরো গরিব হয়। তাই মে দিবসের তাৎপর্যকে সামনে রেখে দেশের শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের অধিকার অগ্রাধিকার দিয়ে সার্বিক বিষয় পরিচালনার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রসঙ্গত : ১৮৮৬ সালের ১ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওইদিন তাদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে।

মহান মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প ও শ্রমবান্ধব বর্তমান সরকার শ্রমিকের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নত কর্ম পরিবেশ, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের পেশাগত নিরাপত্তা ও সুস্থতাসহ সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই।

মহান মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশের মেহনতি মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবন-মান উন্নয়ন ও কল্যাণে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রম আইন যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে।

মহান মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সারাদেশে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

মহান মে দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় পত্রিকাসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দিনটি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান ও টকশো সম্প্রচার করবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads